ওসামা বিন লাদেন, যিনি ২০০১ এর সেপ্টেম্বরে আমেরিকার মেনহাটনের ওয়ার্ল্ড ট্রেইড সেন্টারে হামলার পরিকল্পনাকারী, এর পুত্র হামজা বিন লাদেন সম্প্রতি বিয়ে করেছেন ১৯ জনের একমাত্র মিশরীয় হামলাকারীর মোহাম্মদ আতা’র কন্যাকে। যে হামলায় প্রায় ৩,০০০ জনকে হত্যা এবং প্রায় ৫,০০০ জনকে পঙ্গুত্ব উপহার দিয়েছে।
মধ্য প্রাচ্যের সংবাদ মাধ্যম আল-আরাবিয়া বিবাহটি ইরানে সম্পন্ন হয়েছে বলে খবরটি নিশ্চিত করেছে। অনেক আল-কায়িদা নেতাদের উপস্থিতিতে মৃত ওসামা বিন লাদেনের পুত্র হামজা বিন লাদেন তার বিয়ে সম্পন্ন করেছেন। উপস্থিতদের মাঝে ছিলেন সাবেক মিশরীয় প্রেসিডেন্ট আনয়ার শাদাতের গুপ্তহত্যাকারীর ভাই মোহাম্মদ শউকি আল-ইসলামাবোলি, কোয়েতের সোলাইমান, বিন লাদেনের জামাতা, আবু আল-ঘাইথ এবং সাইফা আল-আদল প্রমুখ।
ছয়
স্ত্রীর ২৪ সন্তানের মাঝে হামজা হচ্ছে লাদেনের সবচেয়ে শিক্ষিত স্ত্রী খাইরিয়া
সবরের একমাত্র সন্তান। খাইরিয়া সবর লাদের জীবিত তিন স্ত্রীর একজন যিনি একজন “শিশু মনোবিধ” যার ইসলামীক স্টাডিসেও পিএইসডি রয়েছে, এবং জিহাদের প্রতি যার ছিল তীব্র অনুরাগ।
হামজা, যে তার বাবার মৃত্যূর প্রতিশোধ নিতে
সংকল্পবদ্ধ, একটি গণ-বার্তায় অনুসারীদের ওয়াসিংটন, লন্ডন, পেরিস এবং তেল-আবিবের উপর যুদ্ধ ঘোষনা করতে অনুরোধ করেছে।
বিন লাদেনের মা আলিয়া ঘানেম |
ব্রিটিশ পত্রিক দ্যা গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে লাদেন মাতা আলিয়া লাদেনকে তার বন্ধুরা সংস্কারবাদী করে তুলেছিলো বলে দাবি করেন। তাঁর চার সন্তানের মধ্যে লাদেন ছিলেন আলিয়ার সাথে ইয়েমেনের মোহাম্মদ বিন লাদেনের সঙ্গে বিবাহের ফসল। ইয়েমেন থেকে অভিভাষণের পর সৌদি আরবের জিদ্দার ‘রেড সী’ বন্দরে মোহাম্মদ বিন লাদেন কুলি হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৫০ দশকের সময় সৌদি রয়াল পরিবারে নির্মাণ কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করার সুবাধে নিজের ভাগ্য গড়ে তোলেন।
ওসামা বিন লাদেনের বয়স তিন বছর যখন তখনই মোহাম্মদ বিন লাদেনের সাথে আলিয়ার বিবাহের সমাপ্তি ঘটে, এবং বর্তমান স্বামী মোহাম্মদ আল-আতাসের সাথে পুনরায় বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। মোহাম্মদ আল-আতাস বিন লাদের গড়া ‘বিন লাদেন কোম্পানীতে কাজ করতেন। অধিকন্তু, ওসামা বিন লাদেন ছিলেন বিন লাদের দশম স্ত্রী আলিয়া ঘানেমের কেবলমাত্র পুত্র।
“আতাস খুব ভালো মানুষ, তিনি ওসামাকে তিন বছর বয়স থেকে বেড়ে তুলেছেন”, বললেন আলিয়া। তিনি ওসামাকে, যে তাঁর মাকে খুব ভালোবাসতেন, এক লাজুক আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমর্থ বালক হিসেবে স্মৃতিচারণ করলেন। তিনি বললেন, “ কিং আব্দুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকজন তার পরিবর্তনের জন্য দায়ী, তাদের একজন ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন সদস্য যে ওসামার আত্মিক পদ-প্রদর্শক হয়ে গিয়েছিলেন, আব্দুল্লাহ আজ্জম”।
|
Inside the Revolution নাকম পুস্তকে লেখক রোযেনবার্গ কিভাবে গ্লোবাল জঙ্গিবাদের
উত্থান সম্পর্কে আলোচনা করেন। মোহাম্মদ রেজা পাহলাভি বা রেজা শাহ্ ছিলেন ইরানের
সর্ব শেষ শাহ্ বা সম্রাট, যিনি
সেপ্টেম্ব ১৬, ১৯৪১ থেকে ১৯৭৯’র ‘ইরান অভ্যুত্থান’
এর সময় পর্যন্ত সম্রাট ছিলেন । এই অভ্যুত্থান ২,৫০০ বছরের পুরনো রাজতন্ত্রকে উপড়ে ফেলে দিয়ে শিয়া মৌলবীদেরকে
রাষ্ট্রের বিষয়াধী হস্তক্ষেপ করার দরজা খুলে দেয়।
‘মহিমান্বিত আয়াতুল্লাহ খোমেনি’ ( আয়াতুল্লাহর শাব্দিক অর্থ হলো ‘অনুকরণ/অনুসরণ করার উৎস বা ধর্মীয় উৎস যা শরীয়তি সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য শিয়া ইসলামের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষকে প্রদান করা হয়) কর্তৃক পরিচালিত অভ্যুত্থানটি বিভিন্ন ইসলামী সংস্থার সমর্থন নিয়ে শাহকে অপসারিত করে।
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রোজেভেল্টই প্রথম কোন ইরানী শাহর সাথে তেহরানে একটি সম্মেলনে রাশিয়ার যোসেফ স্টালিন, ব্রিটেনের উইন্সটন চার্চিল সহ ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে এডল্ফ হিটলারের নাৎসি বাহিনির যুদ্ধ প্রচারণা রুখে দেয়ার উপায় খুঁজতে ১৯৪৩ সাল নাগাদ সাক্ষাত করেন ।
ফলশ্রুতিতে
ইরান আমেরিকা এবং পশ্চিমা মিত্র-বাহিনীর
প্রধান এবং বিশ্বস্ত মিত্রশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। “তিন
দশক ধরে”, রোযেনবার্গ বলেন, “
আমেরিকা ইরানের কাছে উন্নত যুদ্ধ বিমান, নৌ সম্পদ, এবং
অন্যান্য সকল প্রকার আগ্নেয়াস্ত্র সহ সোভিয়েত বোমারো হাত থেকে ইরানের আকাশ সীমাকে
সুরক্ষার স্বার্থে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির রাডার সিস্টেম বিক্রি করে।
কিন্তু
১৯৭৮’র ইরান অভ্যুন্থানে শাহকে ক্ষমতাচ্চুত করা হয়, আর পাহলাভি পরিবার নির্বাসনে পালিয়ে যায় এবং
ইসলামীক জিহাদীরা ক্ষমতা দখল করলে বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্রাগার তাদের দখলে চলে
যায়”।
ইরানিয়ান
অভ্যুত্থানের মৌলে ছিল মধ্যপন্থি,
গণতান্ত্রিক এবং পশ্চিমা
ধ্যানধারার-যা শাহ পোষণ করতেন- বিপক্ষে রাষ্ট্র কার্যে শিয়া ইসলামী মনোভাবের
পুনরাবির্ভাব ঘটানো। বহু দশক ধরে শাহ-তন্ত্র তুরস্কের মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের
প্রয়োগকৃত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অনুসরণ করে আসছিলেন। ইসলামিক
খেলাফতের পতনের পর ১৯২০ দশকের সূচনার দিকে কামাল আতাতুর্ক একটি আধুনিক তুরস্ক
নির্মাণে সমর্থ হয়।
“আতাতুর্কের ন্যায়”, রোযেনবার্গ
বলেন,
“শাহ মহিলাদের বোরখা পরা নিষিদ্ধ করেন এবং সকল অফিস-কার্যে পুরুষদের জন্য পশ্চিমা পরিধান
বাধ্যতামূলক করা সহ তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলাদের ক্লাসে বসার সুযোগ করে দেন, এবং তাদের ভোটাধিকার প্রদান করেন”। শাহর এহেন
অবস্থানকে খোমেনি ইসলাম ধ্বংশের পক্ষে হুমকি বলে চিন্তা করেছিলেন। “শাহ ইসলামকে ধ্বংশে উপনিত হয়েছন” , খোমেনি সতর্ক করে বলেন, আর যার ফলে শাহ এবং খোমেনি ও অন্যান্য ইসলাম
পন্থিদের মাঝে বিরুধ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
অভ্যুত্থানের
কেবল এক বছর পর খোমেনি বলেন, “ আমাদের অবশ্যই অভ্যুন্থানকে সারা বিশ্বে
রপ্তানি করতে হবে”।সুন্নি অধ্যুষিত আরব বিশ্বে শিয়া ইসলামকে রপ্তানি করাই ছিল ইরানিয়ান অভ্যুত্থানের
প্রাথমিক উদ্দেশ্য। স্লোগানই বলে, “Neither East nor West- but the Islamic Republic”
অর্থাৎ ‘পূর্ব নই, পশ্চিমও নই, কেবল ইসলামীক প্রজাতন্ত্র’।
আটারো
শতাব্দি থেকে তৎকালীন সৌদি শাসক মোহাম্মদ বিন সাউদের সঙ্গে ১৭৪৪ সালে মোহাম্মদ
ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের চুক্তি সম্পাদনের পর আরবীয় দীপপুঞ্জ সমূহে ইসলামের কঠোর
ব্যাখ্যার অনুশীলন করে আসছিলেন। আব্দুল ওয়াহাব ‘ওয়াহাবি মতাদর্শের সুচনাকারী’ যা ইসলামের কঠোর ব্যাখ্যা
এবং ইসলাম ভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনার
সমর্থন করে।
মোহাম্মদ
বিন সাউদকে সমর্থন, শক্তি আর অহংকার সরবরাহের বিনিময়ে সম্পাদিত চুক্তির উদ্দেশ্য
ছিল ‘ওয়াহাবি মতাদর্শ আর ‘ওয়াহাবি মিশনের সংরক্ষণ এবং প্রসার। উভয়ের
মধ্যকার মিত্রতা প্রায় আড়াই শতাব্দি ধরে বেঁচেছিল।
ইরানে
শিয়াদের উত্থান আর অভ্যুন্থান সৌদি সম্রাজ্যে ‘ওয়াহাবি মতাদর্শে হুমকির সুচনা করে, কারণ
খোমেনি মনে করেন এটি ছিল শিয়া ইসলামের উত্থান, সুন্নি ইসলামের নয়। অন্যদিকে ‘ওয়াহাবি মতাদর্শি
এবং সুন্নিরা মনে করেন শিয়ারা প্রকৃত মুসলমান নন।
মোহাম্মদ আতা, হামজা বিন লাদেনর শ্বশুর |
মিশরের
হাসানুল বান্না (১৯০৬-১৯৪৯) কর্তৃক সৃষ্ট প্রথম মৌলবাদী আন্দোলন হলো ‘মুসলিম ব্রাদারেন।
তিনি কল্যাণমূলক কাজ আর প্রচন্ড প্রশিক্ষন এবং অস্ত্র অধিকারের মাধ্যমে নৈতিক
জাগরণের প্রচার করতেন; মৌলানা আবু আলা মওদুদির (১৯০৩-১৯৭৯) ‘আল্লাহই একমাত্র
সার্বভৌমের অধিকারী এবং এই সার্বভৌম ন্যায়-পরায়ন শাসক কর্তৃক অনুশীলন করা হয়”, ধারনা; সাইয়্যেদ
কুতুবের ‘পশ্চিমা রক্ত ক্রোসেডের আত্মা বহন করে”; খোমেনির শরীয়া আর শরীয়ার জ্ঞান দ্বারা
শাসিত ইসলামীক সরকার’; এবং আব্দুল ওয়াহাবের রক্ষনশীল ব্যাখ্যা এবং চুক্তির
মাধ্যমে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় বিষায়াধি নিয়ন্ত্রন করার ক্ষমতা আই.. অথাব
আল-কায়িদার মতো মৌলবাদের উত্থানের ভিত্তি প্রস্তুত করে দিয়েছে। যে মৌলাবাদ
প্রতিনিয়তই পশ্চিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে।
এমন
পরিস্থিতিতে সৌদি আরবের House of Saud দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র কার্যে সবচেয়ে পুরাতন
রাজতন্ত্র বিশ্বকে একজন মডারেট মাইন্ডেট রাজপুত্র উপহার দিতে সক্ষম হলো। ইসলাম
মডারেট এবং সৌদি আপোসহীন সাম্রজ্যকে মুক্ত সমাজে রুপান্ত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক
সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। সালমান বলেন “সৌদির পরিবর্তন মানে অবশ্যই এর পার্শ্ববর্তী
অঞ্চল এবং বিশ্বের পরিবর্তন”। এক foxnews সাক্ষাতকারে সালমান বলেন যে তাঁর
পূর্বপুরুষরা দেশকে সমস্যা জর্জরিত পথে ধাবিত করেছেন, আর এখনই সময় তা থেকে মুক্ত
হওয়ার। তিনি বলেন সৌদি আরব একটি জঙ্গি প্রবণ দেশ যেখানে এসে তারা তাদের মতবাদের
প্রসার ঘটার, তিনি আরো বললেন যে ‘ওসামা বিন লাদেন ছিলেন একজন মারাত্বক লোক’।
Prince Salman |
প্রিন্স সালমানের দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করা, Six Flags Theme park এবং দর্শনার্থীদের জন্য Semi Autonomus Tousrist Spot নির্মাণ-যেখানে মহিলারা তাদের খুশিমতচলাফেরা করতে পারবে-এবং সম্প্রতি মহিলাদের যানবাহন চালনা এবং পুরুষ অভিভাবহীন চলাফেরার অনুমতি নিঃসন্দেহে মুক্তমনের দাবি রাখে। তদুপরি, সৌদিকে অসহনশীল ওয়াহাবি মতাদর্শের হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা এবং সুন্নি জঙ্গিদের অর্থনৈতিক সহায়তা রুধ করাটাই সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশিত, যা তিনি বাস্তবায়নের অঙ্গীকারও করেছেন।
ওসামা
বিন লাদেন পুত্রের উত্থান এবং তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার শপত হতে পারে
ওসামা বিন লাদেনের পূণরুত্থান আর হতেও পারে বিন লাদেনের দ্বিতীয় আগমন। যদি প্রিন্স
সালমান সৌদি এবং সম্রাজ্যের বাইরে ওয়াহাবি এবং চরমপন্থি প্রতিষ্ঠানগুলোকে থামানোয়
ব্যর্থ হন, তাহলে চরমপন্থি প্রতিষ্ঠানগুলো আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে, যা হবে মানবতার
জন্য এক মহা হুমিক।
তবে
আশার কথা হলো সৌদি সরকারের হামজার নাগরিকত্ব বাতিল এবং এই বছরের আগস্টে তার
মৃত্যুতে পশ্চিমের প্রতি পূর্বের বিদ্বেষ অনেকটা প্রশমিত হবে বলে আশা করা যায়।
إرسال تعليق